মানসিক বুদ্ধিমত্তা
নাফিসা ইয়াসমিন
আমাদের কর্মজীবন বা বাক্তিগত জীবন, আমাদের এই মানসিক বুদ্ধিমত্তা, অনেক অংশে অনেক কাজকে সহজতর করে তোলে। সে অফিস বা ব্যাবসার কাজ হোক, বা দোকান বাজার, সামাজ কিংবা রোজকার সাংসারিক জীবনে অন্যের মানসিক পরিস্থিতিকে বোঝা এবং নিজের মানসিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে অবস্থা বা পরিস্থিতিকে অনুকূল দিকে চালনা করা সম্ভব। নিজেকে, পরিস্থিতিকে বা পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চাপ মুক্ত করা, সঠিকভাবে বা সুস্পষ্টভাবে বক্তব্য প্রকাশ, সহানুভুতি সপন্ন মনভাব, সমস্ত প্রতিকূলতা ও মতবিরোধ কাটিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব, যদি আমরা সঠিক ভাবে আমাদের মানসিক বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে পারি।
যে কোনো কাজে স্ব–উদ্যোগ এবং কাজের প্রতি দ্বায়বদ্ধতা যে কোন মানুষকে এক নতুন দিশা দিতে পারে । আমরা পৃথিবীর যে প্রান্তে যে কাজই করিনা কেন, সে পেশাগত হোক বা ব্যক্তিগত, সাফল্য আসবেই। স্ব–উদ্যোগ ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে, নিজ লক্ষ্যে স্থির থাকা, কি কাজ করব আর কি ভাবে করব তার সঠিক পরকিল্পনা বিশেষভাবে দরকার। ঠিক যেমন রান্নার আগে আমরা কি করি, কি রান্না করব, কি ভাবে করব, কতটা পরিমান করব সবটা মাথার মধ্যে ভেবে নিই, সেই মতন আনাজ কাটা, মসলা যোগাড় করি এবং শেষ পর্যায় রান্না; তেমনি যদি বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হয় একই কাজটা খাতা-কলমে লিখে, প্রয়োজনে পেশাদারি মানুষের সাহায্যে করি। প্রত্যেকটা কাজ যদি আমরা এই সমীকরণে করি তবে বোধ হয় খুব একটা কঠিন তো হবেই না বরং সাফল্য আসবেই।
সকাল থেকে রাত অবধি আমরা আমাদের সারাদিনের কাজ করি, কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সব কাজ করেও নিজের জন্য সময় বার করেন, বই পড়েন, গান শোনেন, গান করেন, ছবি আঁকেন বা যে কোনো ধরনের শখ মেটান। কি মনে হয় এরা কাজ কম করেন? একদম নয় এরা সব কাজ করেও সময় বার করেন, নিজের জন্য এর দুটো কারণ এক এরা জানেন সময় কিভাবে ব্যাবহার করতে হয়, দুই এরা নিজেদের ভালবাসেন। প্রকৃতি আমাদের একটা জিনিস সবাই কে সমান দিয়েছে সেটা হল সময়, আর এটা আমাদের হাতে, আমরা পরনিন্দা পরচর্চা করব না উপযুক্ত ব্যবহার করব।
কলেজের সুলেখাদি খারাপ পড়ান না, বিষয় সম্পর্কে তার জ্ঞান অবাধ, কিন্তু বড় খিট খি টে মেজাজের । কলেজের মেয়েরা তো বটেই সহকর্মীরাও তাঁকে এড়িয়েই চলেন। এহেন সুলেখাদির পালা এল কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে বাৎসরিক শিক্ষামূলক ভ্রমণে যাবার। ছাত্রীদের সবার কমবেশি মন খারাপ, কিন্তু উপায় তো নেই । সুলেখাদি নিজেও যে খুব আনন্দিত তা কিন্তু নয়, এইসব তার উটকো ঝামেলা বলেই মনে হয় । সদ্য NETএ যোগ্যতা অর্জন করে কলেজে যোগদান করেছে্ন প্রজ্ঞা । অতএব তাকেই হতে হল এই সফর সঙ্গী। ভারী বুদ্ধিমতি মেয়ে প্রজ্ঞা, সুলেখাদির ব্যাপারে যা শুনেছিলো তাতে একটুও দমলেন না । বরং বেশ অত্যুৎসাহিত হয়ে কাজে নেমে পড়লেন। গন্তব্য নির্ধারণ থেকে, টাকা জমা নেওয়া বা টিকিট কাটা, সমস্ত কাজ ভাগ করে দি্লেন মেয়েদের মধ্যে, আর সবাই কে সবকিছুর রিপোর্ট দিতে হবে সুলেখাদিকে। প্রথম দিকে সুলেখাদি ও মেয়েরা খুব একটা খুশি না হলেও ধীরে ধীরে বেশ একটা সমন্বয় তৈরি হয়ে গেল। ভ্রমণের শেষে সুলেখাদি এক অন্য মানুষ। আসলে সুলেখাদির এই মানসিকতার পিছনে ছিল আজীবন পেয়ে আসা চরম অবহেলা। ছোটখাটো চেহারার সুলেখাদি, বাড়িতে কোনদিনই তেমন প্রাধাণ্য পাননি, অন্যান্য বিদুষী ও সুন্দর ভাই বোনদের মধ্যে। মেধার জোরে চাকরিটা পেলেও গুরুত্ব ছিল না তার কারো কাছে। ক্রমাগত অবহেলিত হতে হতে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন বইএর জগতে। তাই বিষয়গত জ্ঞান অবাধ থাকলেও মানবিক দিকগুলো কেমন যেন ঘেঁটে গিয়েছিল। প্রজ্ঞা নিজের স্বভাবজাত 'মানসিক বুদ্ধিমত্তা' দিয়ে সুলেখাদি কে তাঁর গুরুত্বটা যেমন বুঝয়ে ছিলেন সেই সঙ্গে ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর একটা সেতুও তৈরি দিয়েছেল। প্রজ্ঞা পারতেন নিজে সবটা পরিচালনা করে তার কৃতিত্বটা নিতে। কিন্তু প্রজ্ঞা জানেন আগামিতে এই সুলেখাদি তার কত বড় প্রাপ্তি হতে পারে।
আমাদের নিজেদের নিজেকে জানা ঠিক ততটা প্রয়োজন যতটা না অন্য কাউকে জানা। নিজের সবল জায়গাটা জানবো তো বটেই, নিজের দুর্বল জায়গাটাও জানতে হবে। নিজের সবলতা আর দুর্বলতা যদি সঠিক জেনে, সেইটা সঠিক ভাবে চালনা করতে পারি সঙ্গে নিজের আবেগ আর ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তবে পৃথিবী নিজের। এক্ষেএে সুলেখাদির দূর্বল জায়গা ছিল ঠিক ভাবে অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে অক্ষমতা এবং হীনমন্যতা। যেটা ঢাকতে উনি অদ্ভুত ব্যবহার শুরু করেন ছাত্রী, সহকর্মী ও পরিচিত মহলে। প্রজ্ঞা এইখানে সংযোগ স্থাপনের প্রাথমিক কাজটা করেছেন এবং ওনার গুরুত্বটা সামনে এনেছে্ন। অন্যদিকে সুলেখাদির সবচেয়ে সবল জায়গা, যেটা হল বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও ধারনা সেটা ছাত্রীদের ওনার কাছে এনে দিয়েছে।
বরাবরই ভাল রেজাল্ট করা এবং অত্যন্ত দক্ষ কর্মী সুবিমল কেবলমাত্র নিজের কাজটা ঠিক উপস্থাপন না করতে পারার জন্য আজও সাধারণ কর্মী থেকে ম্যানেজার হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ তার থেকে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতা নিয়ে রোহিত একই সংস্থাতে মুম্বাইতে একটা শাখাতে প্রধান হিসাবে রয়েছে। এক্ষেত্রে কাজ করাটা সুবিমলের দক্ষতা কিন্তু কাজ উপস্থাপন তার দূর্বলতা । তার প্রকল্প গুলোতে যদি সুবিমল নিজের একটা ছাপ ছেড়ে দিত তবে অবস্থাটা বোধ হয় অন্য রকম হত।
সহমর্মিতা ও সহযোগিতা এই দুটো আমরা যেমন সবার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি তেমনই বাকি সবাই আমাদের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশা করে। সামাজিক জীব হিসাবে এই দুটি যেমন থাকা জরুরি তেমনই আমাদের খেয়াল রাখা উচিৎ যে আমরা যেন কারোর ব্যাক্তিগত পরিসরে প্রবেশ না করি। সহমর্মিতা অন্তর থেকে থাকা কাম্য আর সহযোগিতা সাধ্যমতন।
রায় বাড়ীর ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া কোর্ট পর্যন্ত গড়ালেও সহমর্মিতা দেখাতে গিয়ে পর-নিন্দা পর-চর্চাটা আমাদের হীনমন্যতার পরিচায়ক । বরং বাগান করা, গান গাওয়া বা নিতান্ত পক্ষে একটা বই এর সাথে সময় কাটানো অনেক বেশী কাম্য। সম্পর্ক আমাদের বজায় রাখতে হয়, সে আমরা চাই বা না চাই। চাকরিটা তো করতেই হবে সে বস যতই বদমেজাজি হোক না কেন। ননদিনী এসে দু-একটা পছন্দের জিনিস নিয়ে চলে যায় প্রতেকবার, কিন্তু সম্পর্ক তো আর শেষ করা যায় না। বোস গিন্নী রোজ বাড়ির সামনে বিড়ালদের মধ্যাহ্নভোজন করান, ফল স্বরূপ রাস্তা জুড়ে ভাত-মাছের কাঁটার ভিড়। কিছু বলা যায় না। কিন্তু সমস্যার সামাধান করতে তো হবেই এবং সেটা সম্পর্কের মধুরতা বাজায় রেখে। এইখানে আমদের দক্ষতার প্রমাণ দেবার জায়গা এবং কতটা দক্ষতার সঙ্গে এবং বুধিমত্তার সঙ্গে সমস্যার সামাধান করব।
সম্পর্ক স্থাপন সহজ। আরও সহজ সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া । কিন্তু সম্পর্ক টিঁকিয়ে যাওয়া সব চেয়ে কঠিনতম ।
মানসিক বুধিমত্তার সঙ্গে আর একটা বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। হয়তো সেটা সঠিক নাও হতে পারে, কিন্তু সৎহৃদয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত খারাপের দিকে যেতে পারে না।
পরিশেষে একটাই কথা বলব Artificial Intelligence যতই উন্নত হচ্ছে আমাদের Emotional Intelligent হবার ততই দরকার হয়ে পড়েছে। World-Wide-Web আমাদের জুড়ে দিচ্ছে আর mental wireটাকে কেটে দিচ্ছে। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার জন্য মানবিক বুদ্ধিমত্তা অপরিহার্য ।
*ছাত্রী, ২০০১
বেশ ভালো লাগল।
ReplyDelete