অন্য ভুবন


   

কস্তুরী দাশ



"বাবা ছোটবেলায় বিয়ে দিয়েছিলতখন আমার দশ বছর বয়স, 'বর' বুঝতাম নাশ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে বাবার বাড়ি চলে এলামসারাদিন মাঠে কাজ করতামগ্রামেরই একটা মেয়ে কলকাতায় কাজে দেবে বলে নিয়ে এলোকলকাতায় জীবন দীপের  কাছে একটা বাড়িতে দু’মাস কাজ করেছিওরা গরুর মাংস খেতকাজটা ছেড়ে দিলামগ্রামের ওই মেয়েটাই তখন আমাকে সোনাগাছিতে নিয়ে গেলবছর দু’য়েক ওখানেই ছিলামওরা খুব মারতোএকদিন একটা দালালের সাথে গুজরাট চলে গেলামসাত আটজন মিলে একটা হোটেলে থাকতাম,  কাজ করতামদেড় বছর এভাবেই ছিলামবনগাঁয়ে বাবা,  মা, বোন থাকতোমায়ের শরীর খারাপ খবর পেয়ে চলে আসতে হলোওদের দেখতে হয়বোন ক্লাস নাইনে পড়ে, ওকে পড়াচ্ছিবাবাকে গরু কিনে দিয়েছিআমার পেশার কথা মাকে বলেছিকান্নাকাটি করছিলআর বাবা জেনেও জানে নাআমি  'আধিয়া' 'ঘরালি' কে মাসে অনেক টাকা দিতে হয় "

"এত সব হিসটিরি লিখে কত টাকা পাবে গো দিদি" মদের নেশায় বিভোর হয়ে বলতে বলতে প্রায় অচৈতন্য অবস্থাআমার কলম থেমে যায়বসিরহাটের অন্তরাngoর অফিস ঘরে সবার প্রথম ওর সাথেই আলাপ হয়েছিল

২০১২র শীতের কলকাতাএকটা ভারত বিখ্যাত সংস্থায় কাজের সুবাদে কলকাতা ও তার উপকণ্ঠে কয়েকটি রেডলাইট অঞ্চলে যেতে হয়েছিলমূলত,  স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমীক্ষা হলেও,  কিছু অর্থনৈতিক অবস্থা সংক্রান্ত প্রশ্নও ছিল

বাস রাস্তা পেরোতেই চোখে পড়েছিল, গলিগুলোর মুখে রঙিন চাউনির ইশারাসেই পথে এগোতেই সরু গলির দু’পাশে সারিবদ্ধ ঘর,  ঘরের সামনে টুল, তাতে প্লাস্টিকের স্টিকারে লক্ষীর পায়ের ছাপএইসব এলাকায় কিছু নামকরা ngo কাজ করে, তাদের সাথে কথা বলে দিনক্ষণ ঠিক করে তবেই এগোনো গিয়েছিলওই ngoর এক কর্মী রমাদি আর একটি অল্পবয়সী ছেলে বিমল আমাকে এই কাজে সাহায্য করেছিলএইসব রেডলাইট এলাকাকে স্থানীয় ভাবে লোকে লাইন বাড়ি নামেই চেনে

বিমল ছেলেটি ওখানকারই বাসিন্দাবিমলের মাও এই পেশাতেই ছিলেনভদ্রমহিলার বয়স সত্তরের কোঠায়অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, সবাই দেশে থাকেবিমল ওর মায়ের সাথে এখানেই থাকে আর ngoর টুকটাক কাজ করে দেয়যেমন আমাকে ঘর চিনিয়ে দেওয়া,  মেয়েদের সাথে পরিচয় করানো এইসব করতো বিমল

বিজলি,  চন্দনা,  কনক,  নাজমা আরো অনেকের সাথেই কথা হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেওরা আসে কাজ করে, তারপর বাড়ি ফিরে যায়এরা  'আধিয়া',  অর্থাৎ খদ্দের পিছু এরা যে টাকা পায়,  তার অর্ধেক এদের, বাকি অর্ধেক  'ঘরালি'যার ঘর এরা ব্যবহার করেএরা সকাল সকালই চলে আসেশাড়ি,  চুড়িদার কাঁধে ব্যাগ, টিফিনবক্সসারাদিন আপামোর খদ্দেরের তোয়াজের পর সন্ধ্যের মুখেই বাড়ি

মাঝে মধ্যে বিমলের মায়ের সাথে গল্প করে আসতামউনি চোলাইয়ের ব্যবসা করতেনদেশে দোতলা বাড়ি করেছেনসেখানেই বর,  ছেলেমেয়ে,  নাতিনাতনি নিয়ে ওনার ভরা সংসারদু’তিন মাস অন্তর বাড়ি গেলেও, ওখানে যে ওনার মন টেকে না সে কথা জানিয়েছিলেনএই লাইন বাড়ির আলো আঁধারী চার চৌহদ্দিতেই উনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন

ওরা বলেছিল, 'বাড়ি ফিরে আমাদের কথা ভাববেনা গো দিদিকোনো কিছুই আর বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না'

মাত্র  ক’দিনেই বড় আপন হয়ে উঠেছিল ওরাগলির মুখে পৌঁছতেই ছুটে আসতো ওরা-পুষ্প,  রিনা, মায়ারাআমার কাঁধের ব্যাগ নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিত,  হাত ধরে মজা করতোখদ্দের না থাকলে,  ওদের কারো ঘরে গিয়ে আড্ডাও হতো মাঝে মধ্যে

চার পাশে সারিবদ্ধ ঘর, মাঝে উঠোন, তুলসিমঞ্চ ঘিরে চালবাটার আলপনাঘরের ভেতরে দুপাশে দুটো চৌকিএকটাতে নিজের শোয়া বসা, অন্যটাতে খদ্দেরের তোয়াজবিনিময় টাকাঠাকুরের সিংহাসন,  কোনো কোনো ঘরে ড্রেসিং টেবিল,  আলনাএমনই এক ঘরের বাসিন্দা ছিল বিবিলম্বা চেহারা, সুন্দর মুখশ্রীবড় ছেলে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে, আর ছোটোটা ওর বাবার সাথে বাড়িতেওর বর সব জানেমাঝে মধ্যে এসে দেখা করার ছলে টাকা নিয়ে যেতসেইসব দিনগুলোতে খুব মন মেজাজ খারাপ থাকতো বিবিরনেশা করত খুব

বিবির ঘর থেকে বেরোতেই চোখ চলে যেত তুলসীমঞ্চের দিকেচোখ তুললে ওপরে ব্রীজলোকেদের উঁকি ঝুঁকিব্রীজের ওপরে খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকা মেয়েদের ইতিউতি দাঁড়িয়ে থাকাখদ্দেরের সাথে দর দস্তুর, ইশারা ইঙ্গিত

কলকাতার উপকণ্ঠে এই লাইন বাড়ির চত্বরটি বিশালঝামেলা ঝাটির বহরও তাই বেশী ছিলহঠাৎই একদিন হুড়মুড়,  ধুপধাপলাইন বাড়ির সব কটা ঘরে তালা লাগানো শুরু হলোজানতে পারি, পুলিশের ভ্যান এসেছেভাবখানা পরিদর্শনেরঘরের ভেতরে যেখানে খদ্দের পুজো চলছে সেখানে বাইরে থেকে তালা লাগানোর নাটকআসল ব্যাপার ছিল,  যে  সব ঘরে কাজ হচ্ছে সেই সব ঘরের ঘরালিদের থেকে জোর করে টাকা আদায়তাই তালা  লাগানোর নাটকমিনিট পনেরোর এই ঝোড়ো নাটকের শেষে তারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেই মাতালটাকে,  যে মদ খেয়ে পড়েছিল নর্দমায়  মুখ গুঁজে আর কিছু ঘুর ঘুরেকে

কোনো  কোনো দিন ইন্টারভিউ শেষ হতে সন্ধ্যে হয়ে যেতরমাদি বারবার বলে দিয়েছিলেন,  সন্ধ্যের আগেই কাজ শেষ করে যেন বেরিয়ে আসিতবুও এক আধদিন দেরি হয়ে যেতদেখতাম,  রাজপথে  আলোর বন্যাঅপর দিকে অন্ধকার গলি, অন্ধকার রাস্তা, পাঁক ঘাঁটা শরীরের সাথে মনের অসম লড়াইয়ে রাজপথে আলোর ঔজ্জ্বল্য এতটুকু কমে নিযে বিরাট আলোর বৃত্তের বাইরে, ওরা নিজেদের সরু অন্ধগলির স্যাঁতস্যাঁতে গা গোলানো পথে গন্ডিবদ্ধ করেছে, তাতে এই সমাজের কিছু এসে যায় কি.. সমাজ বাড়াবে না ওদের দিকে গন্ডি পেরিয়ে আসার হাত, আর ওরাও চায় না এই লোক দেখানো ভদ্র সমাজের অহঙ্কারী দরদতাই,  থাক না ওরা ওদের মতো

এখানে এই লাইন বাড়িতে সব সময় গুন্ডা দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়তাই, বিপদে আপদে সাহায্য পাওয়ার জন্য একটা ছেলেকে আমি রাখিমদ,  গাঁজা, বিড়ি.. সব সব খাইওসব ছাড়া বাঁচবো কেমন করেআমিআধিয়া’.. ঘরালিকে মাসে তিন হাজার দিতে হয়বেশী খদ্দের বসালে,  কোনো কোনো মাসে পাঁচ হাজারও দিতে হয়

এসব অকাজের গল্পএকটানা বলেছিল বাণীঅফিসের ডেটা কুড়োনোর ফাঁকে এই সব অকাজের কথাআধিয়া ঘরালি ব্যবস্থা,  চৌকির ভাড়া,  ফ্যান লাইটের ভাড়া,  নানান হিসেব নিকেশযেগুলো ডেটা নয়লড়াইঘরালিঅর্থাৎ ঘরের মালকিন,  যে বহু টাকা সেলামি দিয়ে এই ঘর নিজের করেছেআর  আধিয়াযে নিজের খদ্দের পিছু রোজগারের অর্ধেক ঘরালিকে দেবেবাকি অর্ধেক তার নিজেরতাছাড়া ফ্যান,  লাইট,  চৌকির ভাড়াও আলাদা করে দেবে

বাণী বলেছিল, কিছু পয়সা জমিয়ে নিজেই একটা ঘর নেবেকিছু মেয়ে রাখবেএকবার ঘরালি হতে পারলে, কাজের চাপ অনেকটাই তার কমবেএমনটাই জানিয়েছিল বাণী

এইসব কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই ওদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার একটা আবছা আভাস পেয়েছিলাম মাত্রইন্টারভিউ এর ফলস্বরূপ এর কতটা ছাপ ধরা পড়েছিল তাতে সন্দেহ থেকে গেছেলিস্ট অনুযায়ী ৩৫টা মেয়ের ইন্টারভিউ হলেও, বাকিদের মধ্যে যারা আজও আমাকে ভাবায়, তিনি ছিলেন সরযূবালা দাশআমার সরযূ পিসীমাএই নামে সম্বোধন করতে উনিই আমাকে বলেছিলেনষাটের ওপরে ওনার বয়স ছিল তখনকলকাতার উপকণ্ঠে সেই লাইন বাড়ির একটি ঘর ভাড়া নিয়ে উনি থাকতেনএক সময় উনি এই পেশায় ছিলেনবয়স হয়ে যাওয়াতে চোলাইয়ের ব্যবসা করতেনউনিই শিখিয়েছিলেন, চষির পায়েস কেমন করে তৈরী করতে হয়মেয়েরা নিজেদের মধ্যে নানান সমস্যা, মারপিটের মীমাংসা করতে এই পিসীমার ঘরেই হাজির হতোএই পেশায় আসা নতুন মেয়েদের উনিই শেখাতেন খদ্দেরের সাথে নানা ব্যবহারিক কৌশল

শেষ দিনে বিজলি,  মমতা একটা চিরকূটে লিখে দিয়েছিল ওদের ফোন নম্বরসরযূ পিসীমা খাইয়েছিলেন সেদ্ধ পুলি গুড় দিয়েবিমলের মা আর সরযূ পিসীমাকে প্রণাম করেছিলামবাকি সব মেয়েদেরও মনে মনেবাস রাস্তা অবধি সঙ্গে এসেছিল বিমলচোখেজল

এখনো মাঝে মধ্যেই মধ্যরাতের অন্ধকারে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, রাত পরীদের একে একে নেমে আসতে দেখিজাদু দণ্ডের ছোঁয়ায় এক পৃথিবী যখন ঘুম চাঁদের হাত ধরে, তখন অন্য পৃথিবী জেগে ওঠেসেই অন্য পৃথিবীর তুলসী মঞ্চের চারদিকে ঘুরে ঘুরে মায়া জোনাকিরা তাদের নর নারায়ণের সেবায় মগ্ন হয়ওদের মায়া শরীরে জোনাকিরা মিট মিট জ্বলেআকাশে শেষ রাতের তারারা জ্বলে ওঠে, আবার নিভে যায়


*ছাত্রী, ১৯৯৪

 

 

 

Comments

  1. খুব সুন্দর লেখা. পড়ে ভালো লাগলো. আরও কিছু এই ধরণের লেখা পড়ার আশা এ রইলাম.

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয়ই লিখবো ব্রতী। অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  2. অন্য ভুবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা ছিল না, যদিও একই সমাজে বসবাস করি। ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  3. সাবলীল বর্ণনা। ভাল লিখেছিস।
    লেখাটা দুম করে শেষ হয়ে গেল। পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
    আধিয়া দের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও জীবন বোধ নিয়ে লেখ না কিছু...

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog