সোনালী জয়সলমীরের সোনালী কথা

 

মৌসুমী ব্যানার্জী


দিল্লী থেকে জয়সলমীরের যাত্রা শুরু হয়েছিল আকাশপথেপরিষ্কার ঝলমলে আবহাওয়ার  এক দুপুরে  বিমানে জানলার পাশের আসনে বসে দেখলাম ভারতবর্ষের রাজধানী শহরের দিগন্ত  জুড়ে নগরসভ্যতার  জয়গাথা সদর্পে ঘোষিত হচ্ছে   কিছু পরেই ফাঁকা জমি, কিছু জল আর  সবুজের আভাস এরপর খুব দ্রুত জানলার পাশে  আকাশে ঝলমলে নীল রঙ  আর অনেক নীচে ধূ ধূ করছে রুক্ষ  ধূসর প্রান্তর   মাঝেমধ্যে কিছু সবুজের ছোঁওয়া প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল  বাদামী পাহাড়ের সারি  পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম, আরাবল্লী পর্বত  দুই পাহাড়শ্রেণীর মাঝে  কখনও সামান্য সবুজ, কখনও বা শুধুই ধূসর হলুদ রঙ, অর্থাৎ বালিছোট্ট জানলাটি দিয়ে যতদূর চোখ যায় এই দৃশ্যই শুধু আমার কাছে এই দৃশ্য নতুনই ছিল কিছু পরে  একটানা উঁচু নীচু সোনালী রঙা জমি  জানিয়ে দিল বিমান থর মরুভূমির অংশ দিয়েই চলেছে  উৎসাহের আতিশয্যে বিমানসেবিকাকে প্রশ্ন করে জানা গেল আধঘন্টার মধ্যেই জয়সলমীর পৌঁছে যাব আমরা তার মানে সত্যিই  বালিয়াড়িউত্তেজনায় মন ভরে উঠছে তখন বিমান অবতরণের প্রস্তুতি শুরু হওয়ার ঘোষণা হতেই দ্রুত চোখের সামনে সোনালী রঙা শহরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট আর অবশ্যই 'সোনার কেল্লা', জয়সলমীর দুর্গদৃষ্টিগোচর হলঅপূর্ব দৃশ্য সে! এমন রঙে রঙীন শহর এর আগে আমি দেখি নি
থর মরুভূমির বুকে ছোটখাট   বিমানবন্দর, জয়সলমীরভারতীয় বায়ুসেনার ঘাঁটি  সোনালী শহরে বিমান অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম রানওয়েটিও সোনালি বালির ছোঁওয়া থেকে বঞ্চিত নয়  সবুজের ছোঁওয়া বিশেষ নজরে এল না জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে বেরোলাম  আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে  অপেক্ষায় ছিলেন গিরধারী সিংজী সংক্ষিপ্ত পরিচয়পর্ব সেরে গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করল রাস্তার দুপাশে বালির স্তূপ অথবা ফাঁকা বালি জমিমাঝখানে পিচের রাস্তাতেও বালির প্রলেপ যত্রতত্র মাথার উপরে সুনির্মল আকাশদোর্দণ্ডপ্রতাপ সূর্যদেব পশ্চিমাকাশগামী   কোথাও এতটুকু ছায়া নজরে এল না  দূরে  দেখা যাচ্ছে   'সোনার কেল্লা'
সূর্যাস্তের আলোয় জয়সলমীর শহর, দুর্গ


আমরা চলেছি জয়সলমীর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তরে 'বড়া বাগ' অর্থাৎ 'বড় বাগান' দেখতে জয়সলমীর শহরের প্রতিষ্ঠা  করেছিলেন মহারাওয়াল বংশের জয়সাল সিং, দ্বাদশ শতাব্দীতে  এই বংশের উত্তরসূরী রাজা মহারাওয়াল জয় সিং (দ্বিতীয়) অষ্টাদশ শতাব্দীতে মরুভূমির বুকে  একটি বাঁধ বড় জলাশয় নির্মাণ করে সুন্দর বাগান তৈরী করেছিলেন রাজা জয় সিং (দ্বিতীয়) মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে জলাশয়ের পাশের ছোট টিলায়  পিতার  নামে প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন অষ্টাদশ শতাব্দীতে  বিংশ শতাব্দীর  স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত  রাজপরিবারের মৃত  সদস্যদের নামে এমন স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরম্পরা বজায় ছিল  হলুদ বেলেপাথর দিয়ে  ছোট বড় নানা আকারে তৈরী এই সৌধগুলি রাজপুত রাজারা হিন্দু ছিলেন প্রতিটি সৌধে  সাদা মার্বেলপাথরের ফলকে খোদিত আছে ঘোড়ায় চড়া একজন মানুষের ছবি সঙ্গে স্থানীয় ভাষায়  উদ্দিষ্ট মৃতের পরিচয় স্মৃতিসৌধগুলিকে 'ছত্রী' বলা হয় পাশেই নির্মিত জলাশয়ের জন্য   কিছুটা  সবুজ এই জায়গাটি  টিলায় যাওয়ার বালির পথটি ধরে আমগাছের সারি মনোরম পরিবেশ তৈরীতে সাহায্য করেছে  বিকেলের পড়ন্ত রোদে সোনালী রঙা ছত্রীগুলি বড়ই সুন্দর লেগেছিল







বড়া বাগ/ছত্রী

এরপর আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম রাস্তার দু ধারের  যে কোনোও স্থাপত্যের মতোই  আমাদের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলটিও  আগাগোড়া হলুদ বেলেপাথরে তৈরী  সিঁড়ি, দেওয়াল, মেঝে সবকিছুই  হলুদ অন্য এক দুনিয়া যেন! হলই বা –  একটি রাতের আস্তানা, – তবুও নিজস্ব একটি সোনালী পাথরের ঘর! ঘরের সাজসজ্জাতেও বৈচিত্র্য উজ্জ্বল লাল, গোলাপী, কমলা রঙা ফিনফিনে পাতলা কাপড় দিয়ে সৌন্দর্য্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে  কাঠের আসবাবগুলিতে রাজস্থানী নকশার পরিচয় সুস্পষ্ট  ঘরের সামনের  একফালি বারান্দা থেকে 'সোনার কেল্লা' দেখা যাচ্ছেগোধূলির লালচে গোলাপী রঙ  তখন  কেল্লার গায়ে

আমাদের এক রাত্রের হলুদ পাথরের বাসস্থান

একটু পরে  আমরা গেলাম হোটেলের ছাদে,  খোলা আকাশের নীচেখাবার ব্যবস্থা সেখানে ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে,  মরু অঞ্চলের নিয়ম মেনে সূর্যাস্তের পর থেকেই  ঠাণ্ডা হাওয়ার শিরশিরানি  পাতলা চাদর গায়ে জড়িয়ে  ছাদ থেকে দেওয়ালির আলোর মালায়  সজ্জিত  জয়সলমীর শহর  দেখেছিলাম  বড় সুন্দর !  দূরে   সোনার কেল্লা  আলোর মালায় সজ্জিত   মুগ্ধ হয়ে গেলাম  রূপকথার দেশ যেন ! 

পরদিন সকাল ন'টায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম তৈরী হয়ে একজন গাইড সঙ্গী ছিলেন সেদিন জয়সলমীর শহরের সর্বত্র প্রাচীনতার ছাপ  রাস্তা বিশেষ চওড়া নয়  সরু গলিপথের দুপাশে বাদামী রঙ ঘেঁষা হলুদ বেলেপাথরের বাড়ি, দোকান বাড়িগুলিও পুরনো বলেই মনে হয়েছিল কোনোও কোনোও বাড়ির খোলা বারান্দা  সুন্দর মূর্তি দিয়ে সাজানো খোলা বারান্দায়রাস্তায়  উজ্জ্বল রঙের ঘাগরা, চোলি, ওড়না পরিহিত মহিলারা ঘোরাঘুরি করছেন, পরস্পর কথাবার্তা বলছেন পুরুষেরা সাদা পোশাকে, রঙীন পাগড়ী মাথায়, কেউ  বা  সাদা পাগড়ীতে বেশী স্বচ্ছন্দ

 

জয়সলমীরের একটি বাড়ি

আমাদের গন্তব্য 'পাটওয়া কি হাভেলি' ১৮০৫ সালে  গুমন চাঁদ পাটওয়া তৈরী করেছিলেন  এঁরা  মূলতঃ ছিলেন সোনা, রূপোর জরির ব্যবসায়ী সুদে টাকা খাটানো এবং বেআইনি আফিমের ব্যবসাতেও এঁরা ধনী হয়েছিলেন বলে শোনা যায়গলিপথে কোথাও গরু, মোষ, কোথাও বা অটো রিক্সাকে সামলিয়ে পৌঁছলাম হাভেলির কাছে   বাদামী রঙা  ফটক পার হতেই দু শো বছর আগে যেন   পৌঁছে  গেলাম ! কানে এল রাজস্থানী লোকসঙ্গীত – 'কেসরিয়া বালম আওনি পধারো ম্হারে দেস' – হাভেলির সামনের খোলা পাথুরে চত্বরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে এক গায়ক বড় আন্তরিক! বড় মন ছোঁওয়া, মন কেমন করা সুরউল্টোদিকে  হলুদ বেলেপাথরের উপর অপূর্ব কারুকাজের   হাভেলির দরজা, জানলা, খিলান, স্তম্ভ নজরে এল টিকিট করে হাভেলির ভিতরে ঘুরতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল ভিতরে রঙীন কাঁচের কারুকার্য চোখে পড়বার মতো ছিল

 


পাটওয়া কি হাভেলি

হাভেলির জানলা থেকে সামনের রাস্তা

হাভেলির জানলা, হলুদ বেলেপাথরে সূক্ষ্ম জালি কাজ
পরবর্তী গন্তব্য ছিল জয়সলমীর দুর্গ– 'সোনার কেল্লাগাইডদাদা  ভাঙা বাংলায় বললেন, "মাণিকদাদা জয়সলমীরবাসীর কাছে ভগবান আমার ভগবান" বলেই বুকপকেট থেকে সত্যজিৎ রায়ের একটি সাদা কালো ফটো বার করে মাথায় ঠেকিয়ে বললেন,  "জয়সলমীরের নাম চারিদিকে আজ তাঁরই জন্য  নাহলে কে চিনত? জয়সলমীরবাসীর  রুটি- রুজির  যোগাড় হয়েছে ওঁর জন্যই"   এমনিতেই 'সোনার কেল্লা' কে নিয়ে বিশেষ উত্তেজনায়, তার উপর কালো পাইপ মুখে দীর্ঘ, ঋজু চেহারার সেই নমস্য বাঙালির  কথা এঁদের মুখে শুনে বিহ্বল হয়ে গেলাম আনন্দে

 

জয়সলমীর ফোর্ট/ সোনার কেল্লার ভিতর

জয়সলমীর দুর্গ বা সোনার কেল্লার অবস্থান শহরের মাঝখানে একটি টিলার উপর পনেরো ফুট উঁচু  প্রাচীরে ঘেরা আটশো বছরের পুরনো দুর্গটিতে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত  নগরবাসীরা সকলেই বাস করতেন বর্তমানে ভারতবর্ষের এই একমাত্র  দুর্গটিতে জয়সলমীরের এক চতুর্থাংশ লোক বসবাস করেন এটিকে তাই  living fort   বলা হয়ে থাকে রাজপরিবারের কর্মচারী, সৈন্য সামন্তের পরিবার এখন বংশ পরম্পরায় এই কেল্লায় বসবাস করেন কেল্লার ভিতরে দোকান বাজারও রয়েছে

 

সোনার কেল্লার ভিতরে জিনিসপত্রের পসরা নিয়ে রাজস্থানী মহিলারা

বিশাল লোহার দরজা পেরিয়ে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করলাম  রাজস্থানী পুতুল, কাঁচের চুড়ি, জামা কাপড়,  উটের চামড়া দিয়ে বানানো নানা জিনিস, ফলের রস ইত্যাদি নানারকমের দোকান দুর্গের ভিতরের রাস্তায় মানুষজনের ব্যস্ততা চোখে পড়বার মতোই কখনও সিঁড়ি, কখনও ঢালু রাস্তা ধরে ওঠা নামা করে দুর্গের ভিতরের, রাজপরিবারের অংশটুকু দেখা হল সোনার কেল্লা ছবির শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে সত্যজিৎ রায় হলুদ বেলেপাথরের  একটি বাড়ি তৈরী করিয়েছিলেন সেটি এখন ভগ্নদশাপ্রাপ্ত কেল্লার ছাদের থেকে নীল আকাশের নীচে রোদে ঝলমল সোনালি জয়সলমীর শহরকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল

 

সোনার কেল্লা ছবির শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে তৈরী বাড়ি

দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল থর মরুভূমি সেদিনের রাত্রিবাস ছিল মরুভুমির বুকে টেন্ট জয়সলমীর শহর ছাড়াতেই রাস্তার দুপাশে শুধুই বালি আর বালি  রাস্তাই চলে গিয়েছে পাকিস্তান সীমানা পর্যন্ত  ফাঁকা রাস্তা  থেকে থেকে কাঁটা ঝোপঝাড়  সিং জী বললেন গাছের নাম "খেজড়ি" মরুভূমির গাছ  গাছে  শিম জাতীয় ফল হয়, নাম শাঙ্গড়ি  মরু অঞ্চলের খাদ্য জোটান আজও বড় কঠিন শাঙ্গড়ি শুকিয়ে রাখা হয় সারাবছরের জন্য  নানারকম মশলা সহযোগে শাঙ্গড়ির  পদ মরু অঞ্চলে বিশেষ মর্যাদা পায়মনে পড়ছিল উটের পিঠে চড়া  লালমোহনবাবু ফেলুদার প্রশ্নোত্তরের দৃশ্যটি  উট কি খায়?  কাঁটা ঝোপঝাড় উত্তর জেনে জটায়ুর প্রশ্ন , "কাঁটা কি ওরা বেছে খায়?" 

 

থর মরুভূমির বুকে

কিছু পরেই  রাস্তার দুপাশে ফাঁকা বালি জমিতে  চোখে পড়ল  একের পর এক  wind mill জয়সলমীরের  সুবিস্তৃত বালির  প্রান্তরে  গড়ে উঠেছে  বিশ্বের চতুর্থ এবং ভারতবর্ষের মধ্যে দ্বিতীয় Wind Park. এটি onshore wind farm.  মরু অঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহে এই  wind park  এর ভূমিকা যথেষ্ট বলে  জানতে পারলাম থর মরু অঞ্চলে বায়ু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০১ সাল থেকে

Wind Mill

বেলা তিনটে নাগাদ পৌঁছলাম বালিয়াড়ির বুকে  রিসর্টে  রিসর্টের দু পাশে বালির পাহাড় তবে এই পাহাড়ে কাঁটাঝোপ আছে বলেই  এমন  রিসর্ট বানান সম্ভব হয়েছে  প্রচণ্ড রোদ তখন খালি চোখে তাকানো যাচ্ছে না রিসর্টের আশেপাশে কিছু গাছ লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে বোঝা গেল সবই  কাঁটাগাছ, বাবুল, খেজড়ি ইত্যাদি রিসর্টের মাত্র বাইশ বছর বয়সী বিহারী তরুণ ম্যানেজারের আপ্যায়ন মুগ্ধ করল  সুন্দর,  সাদা রঙের তাঁবুগুলিকে বড় ভালো লাগছিল আমাদের জন্য নির্দিষ্ট তাঁবুর ভিতরে গিয়ে দেখলাম  সুন্দর খাট,  পরিচ্ছন্ন বিছানা, এমনকি লেপও ! জিনিসপত্র তাঁবুর ভিতর রেখে বেরিয়ে এলাম খোলা জীপ অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য,   দেখতে যাব থর মরুভূমির প্রকৃত রূপ মরুভূমির বুকে সূর্যাস্ত দেখে তবে ফেরা হবে প্রচণ্ড গতিতে জীপ ছুটতে শুরু করল সেই গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দুই হাত দিয়ে জীপের সীট, রড আঁকড়ে ধরে বসবার চেষ্টা করতে হল একের পর এক বালিয়াড়ি পার করে জীপ নিয়ে এসে বালির সাম্রাজ্যে দাঁড় করাল  জীপ ড্রাইভার,  সালোয়ার লম্বা কামিজ পরিহিত  শাকিল খান  নেমে দেখলাম  একটি  অস্থায়ী ছোট  চায়ের দোকান সেখানে  আরোও জানলাম চায়ের দোকানের ব্যবস্থা করা আছে রিসর্টের তরফ  থেকেই  একটি চারপাই বালিয়াড়ি উপর  একটু দূরেই দেখলাম  সাজগোজ করা উট কয়েকটি, গম্ভীর মুখ করে জাবর কাটতে ব্যস্ত চারিদিকে শুধু বালি আর বালি একটার পর একটা বালিয়াড়ি উট কাম চায়ের দোকান কাম চারপাই এর  মালিক  সালোয়ার কামিজ পরিহিত  আলি খান দৌড়ে এসে আমাদেরকে বেশ খাতির করে চারপাই এর উপর বসতে অনুরোধ করলেও আমরা বালির উপরেই গিয়ে বসলাম  সঙ্গে সঙ্গে চায়ের কথাও এল বললাম, একটু পরে চা খাব  এরপর এল মোক্ষম অনুরোধটি উটে চড়বার জন্য বললাম,  'চা খাব ঠিকই, বসছিও এখানে কিন্তু ভাই উটে চড়তে বোল না। জীপে চড়েই হাড় খুলে যাওয়ার দশা, উটে না জানি কি হবেনিরীহ  প্রাণী একটা ভালো  থাকুক, আমিও ভালো থাকি'

 



বালিয়াড়ির বালিতে নকশা

চায়ের দোকানটি শুধুমাত্র কয়েকমাসের জন্য থাকে দোকানের মধ্যেই দোকানমালিকের সংসার পাতা উটগুলিও সংসারের সদস্য  ছোট ছোট আট দশ বছরের কয়েকটি  মেয়ে এসে ঘিরে ধরছে  ট্যুরিস্টদের, পয়সার আশায় আমরাও বাদ গেলাম না  "মধুরকলা পেশ করনা হ্যায়" বলে বালির গড়ানো ঢালে  সুপরিচিত হিন্দী গান গেয়ে নাচতে শুরু করল পয়সা দেওয়া হল এরপরেও  ছেলেদের বয়স্কদের দলও এসে যার যার মতো ' মধুরকলা পেশ' করে গেল পয়সাও দিতে হল একটাই কথা সকলের মুখে – "বাবুজী, হম্ বহৎ গরীব হ্যায়

 

মরুভূমির মাঝে, দিনের শেষে

এইসবের মধ্যেই  বালিয়াড়ি উপরে বসে দেখছিলাম পর্যটকদের আনাগোনা উট পিঠে সওয়ারী নিয়ে  উঠে দাঁড়াচ্ছে আর 'লালমোহনবাবুর' উটে চড়বার দৃশ্য চোখে ভাসছে  দুলকি চালে বালির গড়ান ঢাল বেয়ে উট সওয়ারী নিয়ে নামছে .... অন্যদিক দিয়ে আরোও এক দল উট পিঠে সওয়ারী নিয়ে উঠে আসছে যতদূর চোখ যায় ঢেউখেলানো বালির পাহাড় দেখা যাচ্ছে  সেই  কোন্ এক সময় সবকিছু সমুদ্রের তলায় ছিল !  ওদিকে অস্তগামী সূর্যের আলো মরুভূমির বুকে  অপরূপ শোভা তার কিছুক্ষণ আগেও সূর্যের তাপে গরম বোধ হলেও  সূর্য অস্ত যেতেই গরম উধাও, হালকা শিরশিরে ঠাণ্ডা আকাশে তখন সন্ধ্যাতারাবড় আকারেরজ্বলজ্বল করছে  খোলা আকাশ মাথার উপর যেদিকে যতদূরে চোখ যায় আকাশের কোনও আড়াল নেই সেখানে অজস্র গ্ৰহ, নক্ষত্রের সমাবেশএমনটা মনে হল না আগে কোথাও দেখেছি কিছু পরেই আবার জীপে বসে ফিরে গেলাম রিসর্টে  সেখানে তখন খোলা আকাশের নীচে  রাজস্থানী লোকসঙ্গীত পরিবেশিত হচ্ছে ঠাণ্ডা পড়ছে তখন গরম চাদর তাঁবু থেকে নিয়ে  এসে আসরে যোগ দিলাম রিসর্ট কর্তৃপক্ষ আসরেই চা এবং টা পরিবেশন করলেন মাঝখানে কাঠ জড়ো করে আগুন জ্বালান হয়েছে আগুন ঘিরে রাজস্থানী লোকনৃত্য  শুরু হল  গান নাচের সঙ্গে অনেকের মতো আমিও বাকি ছিলাম না তাল মিলিয়ে যোগ দিতে

এরপর নৈশভোজে রাজস্থানী খাবার   খেয়ে তাঁবুতে ফিরে লেপের নীচে  ঘুমিয়ে পড়তে বিশেষ সময় লাগল না

পরদিন সকাল 'টায়  নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম জয়সলমীরকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না মোটেও  শহর, প্রকৃতির রূপ, মানুষজন বা তাদের পোশাক সবই  একেবারে নতুন  রূপে ধরা  দিয়েছিল  মরুভূমির বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার এক ঝলক  সেদিন আমার  তথাকথিত  সুসভ্য, শহুরে  মনে   অচেনা ছবি  এঁকে দিয়েছিল

*ছাত্রী, ১৯৮৯



Comments

  1. লেখনীর রসসিক্ততায় মরুভূমির এক টুকরো মরুদ্যানের ছোঁয়া । সুপ্ত স্মৃতির নবরূপে আবির্ভাব -- আবারও অতীতে ফিরে ফিরে দেখা ।

    নতুন লেখার অপেক্ষায় ----

    ReplyDelete
  2. জয়সলমীর বললেই সোনার কেল্লা মনে হয়। এখন ছবিগুলো এবং লেখনী সেই কথাই মনে করিয়ে দিল। মরুবাসীর জীবন এবং মরুভূমির টুকরো ঝলসে উঠলো। ভ্রমণ কাহিনী এবং লেখনীর টানে শেষ করলাম। আরও চাই

    ReplyDelete
  3. খুউউউব ভালো লাগলো অনেক শুভেচ্ছা শুভকামনা রইলো

    ReplyDelete
  4. সোনার কেল্লার মতোই ঝকঝকে সুন্দর লেখা ও ছবি। খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  5. Asadharan lekha. Money mone Jaisalmer ghora joye galo. Pics gulo apurbo

    ReplyDelete
  6. সকলকে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  7. খুব ভালো লিখেছেন দিদি

    ReplyDelete
  8. সোনালী শহর ...সোনার কেল্লা ...থর মরুভূমি ...খুব সুন্দর একটা ছবি এঁকেছ তোমার লেখনীর মাধ্যমে। সাথে সুন্দর সুন্দর ছবি। মন ভরে গেল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Plant trees more to save Mother Earth