নতুন ঠিকানা


মধুশ্রী ঘোষ


আজ
সকাল থেকে খুব ব্যস্ত অনুরাধা জলখাবার কি মেনু থাকবে, লাঞ্চ বা ডিনার বা কি রান্না করবেকোন্ কোন্ খাবার অর্কপ্রভ খেতে ভালবাসে সেগুলো অনেক দিন আগে থেকেই মনে করে রেখেছিলেন অনুরাধা ঠিকে কাজের লোক পুষ্প কে দিয়ে বাজার করিয়ে রেখেছিলেন দুদিন আগে থেকেই বাজার যাবার আগে পুষ্প কে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ভাল জিনিস আনার কথাএকটু বেশি দাম হলে যেন জিনিস গুলো নিয়েই বাড়ি ফেরে বাজার ভালোই করেছিল পুষ্প অনুরাধা বেশ পছন্দ হয়ছে সব কিছু বিকেলে বাড়ি যাবার  আগে পুষ্প যা যা রান্না  হবে সব কেটে, গুছিয়ে রেখে দিয়েছে ফ্রিজ আজ অনুরাধা ছেলে অর্কপ্রভ আসছে আমেরিকা থেকে, সঙ্গে পুএবধৃ সৃজিতা এক মাএ নাতনি তিতলি আসছে।  
      
অনুরাধা সান্যাল বাড়িটা নিউ আলিপুর অঞ্চলে ছিমছাম, দোতলা বাড়ি বিয়ে পর অনুরাধা এই বাড়িতেই উঠেছিলেন  তখন বাড়িতে কতো লোক শশুড় শাশুড়ি দুই ননদ, অনুরাধাস্বামী পরিতোষ শাশুড়ি মুখঝামটা খেলেও ননদদের সঙ্গে তার খুব ভাব ছিল, পরিতোষ ছিলেন মাটির মানুষ দিন গুলো খুব সুখেই কাটছিল বিয়ের দুই বছর পর অর্কপ্রভ জন্মাল ননদের একে একে বিয়ে হয়ে গেল শশুড়, শাশুড়ি দুজনেই এক বছরের ব্যবধানে মারা গেলেন অনুরাধা সাধ ছিল অর্ক কে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পরাবেন পরিতোষে সেই ইচ্ছায় সায়ে ছিল অর্ককে যাদবপুরে কাছে একটি ভালো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভরতি করিয়ে দিলেন ওঁরা স্কুল বাসে পাঠাবার ব্যপারে আাপওি ছিল অনুরাধা সকালবেলা পরিতোষ অর্ককে স্কুল নিয়ে যেতেন, তারাতাড়ি স্বামীর অফিসের খাবার গুছিয়ে অনুরাধা ছেলেকে স্কুলে আনতে যেতেন, ছুটির এক ঘন্টা আগে পৌছে যেতেন যদি ছুটি হয়ে অর্ক মাকে দেখতে  না পেয়ে কাঁদে তাই বাড়িতে গিয়ে ছেলেকে স্নানখাওয়া দাওয়া করিয়ে ঘুম পারান চারটের সময় সুইমিং ক্লাব নিয়ে যাওয়া-৩০র মধ্যে বাড়ি ফিরতেই হবে, না হলেই বাড়ির  আন্টি ফিরে যাবেনপড়া্শোনায় বরাবরই ভালোই অর্কপ্রভ স্কুলে র্ফাস্ট হতো স্কুল, কলেজে পড়া শেষ হল  ভালো চাকরি পেল অর্কপ্রভ, আমেরিকাতে। অনুরাধা —  পরিতোষের ইচ্ছে ছিল না যে একমাএ ছেলে বাড়ি ছেড়ে ওত দূড়ে থাকুক  কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেলে ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর আপত্তি করলেন না বাড়িতে এখন ওরা মাএ দুজন খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে সারাদিন আগে কত ব্যস্ত  থাকতেন ছেলেকে নিয়ে, এখন যেন সময় কাটতেই চায়না দুজনের পরিতোষ এখন রিটায়ার করেছেন সকাল সন্ধে একটু হাঁটতে যাওয়া , তারপর বাড়ি ফিরে টিভি দেখা মাঝেমাঝে ছেলেকে ফোন করে অনুরাধা ভালোই আছে অর্ক ২৭ বছর বয়স হল অর্কদুজনেই ঠিক করল এবার  ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করা উচিত অর্ক কলেজ লাইফের বন্ধু সৃজিতা, ওকে বেশ পছন্দ ছিল অর্ক এর আগে সৃজিতা এসেছে ওদের বাড়িতে দুই পরিবারের কথা বলার পর বিয়ের দিন ঠিক হলখুব ধুমধাম করে বিয়ে হল ওদের মাসখানেক কাটিয়ে ছেলে বউমা চলে গেল আমেরিকায় আবার বাড়িটা কেমন যেন  ফাঁকা হয়ে গেল মাস ছয়েক পরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরেন পরিতোষ আত্মীয় স্বজন, পাড়াপড়শিদের ডেকে হসপিটালে দেওয়া হয়েছিল অনুরাধা স্বামীকে কিন্তু বাঁচানো গেল নাহার্টফেল করেছে পরিতোষের ছেলেকে আমেরিকায় খবর দেওয়া হল, ছেলে-বৌমা এলকাজকর্ম শ্রাদ্ধশান্তি সবমিটিয়ে ওঁরা আবার  আমেরিকা ফিরে গেল
    
এবার বাড়িতে সম্পূর্ণ একা অনুরাধাঠিকে কাজ করার জন্য পুষ্পকে রাখলেন সবই করে দিয়ে যায়, শুধু রান্নাটুকু করেন অনুরাধা হাতে এখন প্রচুর সময় সময় যে কাটতেই চায়  না এরই মধ্য ফোনে জানাল অর্কপ্রভ যে তাদের মেয়ে হয়ছে- মানে অনুরাধার নাতনী কি যে ভালো লাগছে অনুরাধার, আর মনে মনে ভাবছেন যদি পরিতোষ দেখে যেতে পারতেন কতই না খুশি হতেন ছেলে মোবাইল  ছবি পাঠালো নাতনীরকি মিষ্টি দেখতে  হয়েছে একেবারে অর্ক মত।  এতদিন সংসার নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকার জন্য বন্ধু বান্ধবদের সাথেও খুব একটা যোগাযোগ নেই অনুরাধার - একমাত্র  ছোটবোন শ্বেতা বেঁচে নেই  ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত নন অনুরাধা বোনের ছেলে এসে অনেক বার শিখিয়ে দিয়েছে কিন্তুু মাথায় থাকেনা অনুরাধার। 
 
৫বছর পর ছেলে, বৌমা, নাতনি আসছে এই প্রথম নাতনি কে দেখবে আনুরাধা, এই নিয়ে কত কল্পনাই না করেছেন মনে মনে  অর্কপ্রভ আর মাসখানেকের মধ্যেই দিল্লী বদলী হয়ে আসছে তাই প্রথমে মা কাছে কিছু দিন থেকে তারপর দিল্লীতে সিফট্  করবে, এই রকমই ভাবনা চিন্তা ওদের অনুরাধাও মনে মনে একটা প্ল্যান্ করে ফেলেছেন, কিন্তু এখন ছেলেকে কিছু জানান নি পরিতোষ বেঁচে থাকতে অনেকবার অর্কপ্রভ বাবা মা কে অনুরোধ করেছে আমেরিকা ওদের কাছে এসে থাকার জন্য কিন্তু পৈতৃক  বাড়ি ছেড়ে বিদেশে যাবেন, বাড়িটা কে দেখবে - এই সব ভেবে যেতে রাজি হননি পরিতোষ মৃত্যু পর ছেলে, বউমা বিদেশ ফিরে যাবার সময়ে অনুরাধাকে বলেছিল ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে কি জানি নতুন পরিবেশে মানাতে পারবেন কিনা ভেবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি কিন্তু এবার একেবারে মনস্থির করে ফেলেছেন- একা থাকতে আর ভালো লাগছে না আর দিল্লী খুব দূরে নয় মাঝে মাঝে পুজোর   ছুটি সময় বাড়িটাও দেখে যেতে পারবেন ছেলে কথাটা শুনে খুব খুশি হবে নিশ্চয়ই, ভেবে মনটা খুশিতে ভরে উঠল অনুরাধার
           
রান্না  করতে করতে এসব নানা কথা ভাবতে লাগলেন এতক্ষণে রান্না শেষ হল তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নিয়ে, বারান্দা গিয়ে দাঁড়লেন অনুরাধা  আজ সকালে পূজো সেরে নিয়েছেন তিনি এত দেরী হচ্ছে কেন ওদেরফোন করবেন? আবার ভাবছেন হয়ত রাস্তায় ফোন ধরতে অসুবিধা হবে ওদের আজকাল বেশিক্ষণ এক ভাবে বসতে পারেন না, পিঠে কোমরে কেমন ব্যথা ব্যথা করে ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে পরলেন কেন এত দেরী হচ্ছে কে জানে  হয়ত ফ্লাইট্  লেট্।  
 
স্নান সেরে অর্কবৌমা অনুরাধা একমাত্র  নাতনি খেতে বসেছে, অনুরাধা সার্ভ করেছেন লাউ চিংড়ি খেতে খেতে অর্ক বলল — “খুব ভাল হয়ছে মা, আর একটু ভাত দাও অনেকদিন তোমার রান্না খাই নি ,অপূর্ব হয়ছেতিতলিকে খাইয়ে দিচ্ছেন অনুরাধা এই কয়েক ঘন্টার  মধ্যে নাতনির সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে তাঁর সৃজিতা খুশি হয়ে খাচ্ছে  একটা সাইকেল রিক্সা জোড়ে হর্ণ  বাজিয়ে যাচ্ছে ঘুমটা ভেঙে  গেল অনুরাধার ওহ্ এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন! ফ্রিজ থেকে জলের বোতলটা বের  করে খেলেন অনুরাধা; গলাটা কেমন যেনো শুকিয়ে যাচ্ছে

হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠলো দরজা খুলে দেখেন অর্ক এসেছে কিন্তু বৌমা, নাতনি ওরা কোথায়? অর্ক জানান ওরা দিল্লী ফ্ল্যাটে উঠেছে ঘর গোছাতে ব্যস্ত সৃজিতা, তাই আসা হয়ে ওঠেনি । 
       
স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে অর্কপ্রভ কি সব অফিসের কাজ করছে অনুরাধা ছেলের পাশে বসে নানারকম পুরোনো গল্প করে যাচ্ছেন অনেকদিন পরে ছেলের সাথে সময় কাটাতে পেরে খুব ভালো লাগছে অনুরাধামা তোমার সুরজিৎকে মনে আছে!? আমার স্কুল কলেজ জীবমের বন্ধুঅর্ক জিজ্ঞাসা করলহ্যাঁ মনে পরেছে ওর বাড়ি তো বেহালাউত্তর দিলেন অনুরাধাআর সুরজিতে মামানে কাকিমাতো তোমার কথা খুব বলেনথাকবে দু'দিন ওদের বাড়ি?” অনুরাধাকে জিজ্ঞাসা করে অর্কআর তুই থাকবি তো, খুব ভালো কথা বলেছিস, আনন্দ হবে খুব অনেক পুরোনো গল্প করতে পারবঅনুরাধা বলেন কথা অনুযায়ী পর দিন বিকেলে কিছু জামাকাপড় প্যাকিং করে মা - ছেলে রওনা দেয় সুরজিৎদের বাড়ি যাবার জন্য বেরবার আগে বার বার দেখে নেন অনুরাধা গ্যাস বন্ধ আছে কিনা, কল বন্ধ আছে কিনাদরজা জালনা ঠিক মতো বন্ধ আছে কিনা পুষ্প কে বারতি খাবারগুলো গুছিয়ে দিয়ে ফ্রিজ বন্ধ করে দিলেন অনুরাধা ফোনে ক্যাব বুক করেছে অর্ক গাড়ি এসে গেছে মা ছেলে পাশাপাশি  বসল দুজন গাড়িটা একটা বড় গেটওয়ালা বাড়ির সামনে দাঁড়াল দারোয়ান গেট খুলে দিল গাড়িটা লন দিয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকল কিন্তুু এটা তো সুরজিতে আগের বাড়িটা নয়, তাহলে সুরজিৎ নতুন বাড়ি নিয়েছে বোধহয় ভাবতে লাগলেন আনুরাধা লনের পাশে অনেকগুলো বসার সিট আছেমা তুমি এখানে একটু বসো আমি একটু মিস্টি নিয়ে আসি” অর্ক  বলল অনুরাধা চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন ছেলের জন্য অনেকক্ষণ  হয়ে গেছে আসছে না কেন অর্ক কে জানে
দারোয়ান এসে বলল, “মাসিমা এবার ভেতরে যান আর ব্যাগটা আমার হাতে দিতে পারেন  আমি পৌছে দিচ্ছি এটা বৃদ্ধাশ্রম আজ থেকে আপনি এখানে  থাকবেন
কি বলছে দারোয়ানসমস্ত পৃথিবীটা যেন অনুরাধার কাছে অন্ধকার হয়ে এল চোখের  সামনে জল ভরা চোখে গেটে দিকে তাকিয়ে, দারোয়ানের সঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমের দিকে এগিয়ে  চললেন অনুরাধা
অর্কপ্রভ এখন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে এক সপ্তাহ সৃজিতাদের বাড়িতে কাটিয়ে ওরা দিল্লী ফিরে যাবে হঠাৎ হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠল সৃজিতা ফোনওদিকে সব ঠিক আছে তো” সৃজিতা জানতে চায়হ্যাঁ দিয়ে এসেছি মা কে, বৃদ্ধাশ্রমে নামটাশান্তির আশ্রয়বেহালা কাছে”, অর্কপ্রভ জানায়এবার তাড়াতাড়ি চলে এসো বাবা মা তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন তুমি এলে ওরা খেতে বসবে্নএই বলে ফোন শেষ করে সৃজিতা আর অর্ক ঐ বাড়ি যাবার জন্য ট্যক্সিতে উঠে বসে  
 
অর্কপ্রভ একদিন ওর নিজের ভুল বুঝতে পারবে যখন ওদের একমাএ মেয়ে তিতলি ওদের সাথে এমন আচরন করবে কিন্তু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি যেন ওর বাবা মতো না হয় তিতলির মতো অন্য ছেলেমেয়েরা যেন বাবা মা কে বৃদ্ধ বয়েসে ভালোবাসা আন্তরিকতা বাঁধনে বেঁধে রাখে

*ছাত্রী, সাম্মানিক তৃতীয় অর্ধবর্ষ                                           

                              

Comments

  1. খুব ভালো লেখা। মনটা খারাপ হয়ে গেলেও, শেষে যে সচেতনতার বার্তা দিলে তা মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Plant trees more to save Mother Earth