জলদাপাড়ায় একদিন

 

ডঃ শারদা মণ্ডল


স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে পরিবেশ ভূগোল পড়াতে গিয়ে, জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের ওপরে ডিসার্টেশন করিয়েছি, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এই বিষয়ে যৌথভাবে সেমিনারও করেছি কিন্তু মনের মধ্যে একটা খুঁত খুঁতুনি ছিল, কারণ এতদিন জলদাপাড়া আমি নিজের চোখে দেখিনি তাই এবার যখন পরিবারের সাথে জলদাপাড়া আসার কথা হল তখন মনে বেশ আনন্দ হয়েছিল সেটা অস্বীকার করতে পারছিনা


জলদাপাড়া সরকারি ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছলাম বেশ বেলায় সামনে সাইনবোর্ডে লেখা আছে “Experience Bengal, The Sweetest Part of India” ব্যবস্থাপনা, পরিষেবা, বাগান, ঘর সব কিছু প্রথম দর্শনেই বেশ ভালো লাগল হাতে বেশি তো দিন নেই তাই পৌঁছেই কর্তামশাই হাতি সাফারির টিকিটের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন কপালজোর ছিল, তাই পরের দিনের টিকিট পাওয়া গেল তবে আমরা গিয়েছিলাম বেশ কিছু বছর আগে এখন শুনেছি অনলাইনে বুকিং করে যেতে হয় ওখানে গিয়ে আর টিকিট কাটা যায়না তবে হাতি সাফারির দক্ষিণা অন্য পরিষেবার তুলনায় বেশ চড়া আর খুব ভোরে উঠে প্রস্তুত হতে হয় বাইরে গিয়ে বিশ্রাম করবো, হাত পা ছড়িয়ে দেরী করে উঠবো ভাবলে অভিজ্ঞতার আশা ছাড়তে হবে কর্তামশাই টিকিট হাতে লজে ফিরে, ছোটো সদস্যদের খুব ভালো করে সাবধান করে দিলেন, যে ঘুম থেকে উঠতে পারবেনা, তাকে থেকে যেতে হবে বাকি দল তার জন্য দাঁড়াতে পারবেনা তবে পরদিন আমরা যাবো তৃতীয় মানে শেষ সাফারিতে পোষা  হাতিরা খুব ভোরে মোট তিনবার পর্যটকদের ঘোরাতে নিয়ে যায় যত ভোরে যাওয়া যাবে জলদাপাড়ার গন্ডার রাজাদের দেখতে পাওয়ার সুযোগ ততো বেশি জানিনা আমাদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কিনা

বনদপ্তর থেকে গাড়ি এসে দাঁড়ালো সকাল সওয়া ছটায়  সাড়ে ছটার মধ্যে আমরা লজ থেকে বেরিয়ে পড়লাম সময়টা শীতকাল ভোরের আলো সবে ফুটছে পিচ রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল, দুপাশের গাছগাছালির মাথায় আলো, তলাটা তখনও ছায়া পাখিরা ওড়াউড়ি শুরু করেছে আগের দিন কর্তামশাই বহুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে খানিকটা ভাগ্যক্রমে তিনটে হাতির বুকিং পেয়েছেন দলে আছি বিভিন্ন বয়সী ১২ জন আমাদের জিপ গাড়িটা সোজা ঢুকে পড়লো জঙ্গলের ভিতরে, থামলো ঠিক হলং বাংলোর সামনে বাংলোর সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, যাতে জীবজন্তু বাংলোর খুব কাছে না আসে ওখানে একটা চায়ের দোকান রয়েছে এক কাপ করে গরম চা খেয়ে আমরা আমরা হাতির দলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম 

এক কাপ করে গরম চা খেয়ে আমরা আমরা হাতির দলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম

সামনে হলং নদীর ওপারে গাছ কেটে ফাঁকা করা আছে কাটা গুঁড়ি গুলোর ওপরে পুরু করে নুনের স্তর করা রয়েছে ওপারে নুন খেতে পশুপাখি এলে এপার থেকে দর্শকেরা তাদের দেখতে পাবে সকালের আলোয় হলং নদীর জলের তলায় নুড়ি পাথর স্পষ্ট দেখা যায় আর গাছে গাছে টিয়া পাখির ঝাঁক - কি তাদের ্যস্ততা আর কতো কথা  দুই মরা ডালের মাঝে বসে আছে এক সারপেন্টাইন ঈগল - তার ডানার রঙ আর গাছের ডাল মিলে মিশে একাকার বসে আছে নিশ্চুপ খুব খেয়াল না করলে বোঝা মুশকিল দেখলাম খুব  বিশাল বিশাল ময়ুর, এছাড়াও মাছরাঙা, নানান রকম পায়রা, বুলবুলি, শালিক আর আছে ঝকঝকে কাঁচের মত নালার জলে বোরোলি মাছের আনাগোনা নিজেরা চুপ থেকে একমনে ভোরের জঙ্গলের নানা শব্দ শুনতে লাগলাম  

দেখলাম খুব  বিশাল বিশাল ময়ুর

প্রায় ঘণ্টা খানেক অপেক্ষার পর চারটে হাতি পিঠের ওপর পর্যটক বসিয়ে জঙ্গল ঘুরে ফিরে এলো শুনলাম এটা দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হল এবারে তৃতীয় পর্যায়ে আমরা যাব আমাদেরটাই আজকের শেষ সওয়ারি চারটিই হস্তিনী, কারণ মদ্দা হাতিকে এভাবে কাজে লাগানো হয়না আমি বসলাম যে হাতির পিঠে তার নাম প্রিয়দর্শিনী বাকি তিনটির নাম হল মীনাক্ষী, আম্রপালি আর ডায়না এই তিনটিই মা হাতি, তাদের ছানারা মায়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে জঙ্গলের পথে চলেছে মীনাক্ষী আর আম্রপালির ছানাদের বয়স আড়াই আর তিন বছর শুধু ডায়নার ছানাটাই বড্ড কচি, বয়স মাত্র এগারো মাস তার কচি মুখ, খাড়া খাড়া চুল আর দুষ্টু চোখ দেখে আমার তাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু মাহূত বলল যে বাচ্চার কাছে গেলে মা হাতি শুঁড়ে জড়িয়ে আছাড় দেবে, আর পা দিয়ে মাথা থেঁতলে দেবে শুনে আর এগোলাম না বাবা

হাতির ছানারা মায়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে জঙ্গলের পথে চলেছে


এগারো মাসের ছোট্ট ছানা, মায়ের নাম ডায়না

আমাদের পিঠে চাপিয়ে ভেজা ভেজা শুঁড়ি পথ বেয়ে হাতির দল এগিয়ে চললে এর আগে গরুমারা অভয়ারণ্যে আমি জিপ সাফারি করেছি কিন্তু জিপ যায় রাস্তা দিয়ে গাড়ি গুলোর ভালো রক্ষণাবেক্ষণ হয়না ভীষণ আওয়াজ হয় তাই জীবজন্তু দেখা দেওয়ার বদলে আরো দূরে সরে যায় এখানে সেই সমস্যা নেই

ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম জঙ্গলের চারটে স্তর জঙ্গলের মেঝে আগাছায় ভর্তি এটা হলো প্রথম স্তর তার ওপরে মাঝারি উচ্চতার গাছ সেটা হলো দ্বিতীয় স্তর একেবারে ওপরে আছে অনেক উঁচু উঁচু গাছের সারি সেটা হলো তৃতীয় স্তর আর এই তিন স্তরকেই জড়িয়ে আছে নানা রকম লতাপাতা আর অর্কিড সেটা হলো চতুর্থ স্তর আমি শহরের মেয়ে গাছ চিনি না তাই অনেক গাছ দেখেও যেন দেখা হলো না অনেক কিছু না দেখা রয়ে গেল তবে একটা গাছ চিনতে পেরেছি, জঙ্গল ভর্তি কারি পাতা গাছ


জঙ্গলের বিভিন্ন স্তর 

পুরো জঙ্গল জুড়ে হলং নদীর অনেকগুলো ধারা আছে স্বচ্ছ কাঁচের মত হলং নদীর জলধারার মাঝখান দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম হঠাৎ দেখি মীনাক্ষী আর আম্রপালির  ছানা দুটো মায়ের পাশ ছেড়ে জলে খেলা করতে শুরু করেছে আর মা হাতিরাও দাঁড়িয়ে পড়েছে মাহূত ছড়ি ঘুরিয়ে বলে উঠলমিলে মিলে”, জিজ্ঞাসা করে জানলাম মিলে মানে এগিয়ে চলো নদী পেরিয়েও ছানাদের খেলার নেশা গেল না তারা দুজনে ঠেলাঠেলি করতে লাগল তাতে দুই মা হাতিইঘাঁক ঘাঁকআওয়াজ করে ছানাদের বকে দিল আমার বেশ মজা লাগল কচি ছানাটা এসব কিছু দুষ্টুমি করতে পারেনি তার মাহূত মাঝে মাঝে মাকে একটু পাশে নিয়ে যাচ্ছে কচি ছানাটা কিছুটা হাঁটার পরেই মায়ের দুধ খাচ্ছে আমি আগে কখনো হাতির ছানার দুধ খাওয়া দেখিনি বড় ছানাগুলোকেও তাদের মায়েরা যেসব লতাপাতা পছন্দ হচ্ছিল, সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছিল মা আর সন্তানের সম্পর্ক সব প্রাণীর ক্ষেত্রে তো একই এই পাতা খাওয়ানোর জন্য মা হাতিরা মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে মাহূত বলছে, “বেরি, বেরি, মিলে মিলে”, মানে ছাড়ো ছাড়ো, এগিয়ে চলো জঙ্গলের এত সরু পথ দিয়ে আমরা চলেছি, যে গাছের ঝুরি, শক্ত ডাল, পাতা আমাদের মুখে চোখে লাগছে মাহূত তাই তার হাতের ছড়ি দিয়ে ডাল পাতা ঠেলে রাখছিল এই করতে গিয়ে একজন মাহূতের হাত থেকে তার ছড়ি পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে মাহূত বলে উঠল, “ধাইর, ধাইর”, মানে ধরো ধরো হাতি অমনি শুঁড়ে করে লাঠিটা নিয়ে মাহূতের হাতে তুলে দিল আবার মাহূত ইঙ্গিত দিলে হাতি মট মট করে ডাল ভেঙ্গে পথ করে নিচ্ছিল

স্বচ্ছ কাঁচের মত হলং নদীর জলধারা, জলের তলায় নুড়ি পাথর স্পষ্ট দেখা যায়

লক্ষ্য করলাম জঙ্গলের ঘনত্ব কমে আসছে হঠাৎ দেখি জঙ্গল আর নেই বড় বড় ঘাসের মধ্যে এসে পড়েছি আমরা যে হাতির পিঠে এত উঁচুতে বসে আছি, কিছু কিছু ঘাস আমাদের মাথার থেকেও লম্বা সামনে এক হাতি সওয়ারির থেকে পর্যটকদের চিৎকার শোনা গেল, “ যে, যে”, দেখলাম ঘাসের মধ্যে এক বিশাল একশৃঙ্গ গন্ডার কিন্তু একি!!! গন্ডারটার সারা শরীর রক্তাক্ত মাহূত বলল অন্য গন্ডারের সঙ্গে লড়াই করে ওর এই অবস্থা হয়েছে তাকে ছেড়ে ঘাসের জঙ্গলে এগিয়ে চললাম দেখলাম ঘাসের মধ্যে বড় বড় কাশ ফুলের মত শিষ, কিন্তু একটু শুকনো এবারে দ্বিতীয় গন্ডারের দেখা পেলাম ঘাসের দৈর্ঘ্য বেশি হলেও তা গাছের জঙ্গলের মত দৃষ্টি আটকায়না তাই দেখলাম দিকচক্রবালে মেঘের মধ্যে পাহাড়ের সারি পেঁজা মেঘের আড়ালে ঝকঝকে নীল আকাশ নীল সাদার মধ্যে রুপোলী চিকচিকে কি ? দেবতাত্মা হিমালয় কি আজ আমাদের ওপরে এতটাই প্রসন্ন!! না! আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই দূরে বরফে ঢাকা আবছা পর্বতশ্রেণীর মধ্যে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা কিছুদূর যেতে তৃতীয় গন্ডারের দেখা পাওয়া গেল কিন্তু শরীরী ভাষা দেখে বোঝা গেল তার মন ভালো নেই যে হাতি এগিয়ে গিয়ে গন্ডার স্পট করেছিল, তার মাহূত একটু দূরে অপেক্ষা করতে লাগল কাছে গেলনা বাকি তিনটে হাতি এসে পৌঁছলে ভালো করে পর্যটকদের গন্ডার দেখানোর জন্য একসঙ্গে এগোল মাহূত বলল রাগী গন্ডার আক্রমণ করতে পারে তাই দল বেঁধে চলতে হবে গন্ডারটা একধরনের লালচে ঝোপের মধ্যে আড়াল নিল ঝোপটায় খুব চেনা চেনা কিন্তু একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পাচ্ছিলাম হো, অনেকটা জায়গা জুড়ে যে বন তুলসীর ঝোপ

রক্তাক্ত গন্ডার 

কিছুদূর যেতে আরেকটি গন্ডারের দেখা পাওয়া গেল


গন্ডারটার আমাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিলনা এমন হতেও পারে সেই রক্তাক্ত গন্ডারের সঙ্গে লড়াইতে হেরে গেছে, তাই ওর মন খারাপ উচিৎ ছিল ওকে ওর মত থাকতে দেওয়া কিন্তু মানুষের লোভ, অন্যের মনের কথা শুনতে চায় না আমাদের তাড়নায় গন্ডার বেচারা বড় গাছের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল

ফেরার পথ আগের মতই, তবে উপরি পাওনা হলো ময়ুরের ঝাঁক আর তাদের পেখম তুলে নাচ

ফিরে এলাম হলং বাংলোর সামনে এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা পেলাম হাতির পিঠ থেকে নেমে পর্যটকরা খুশি হয়ে মাহূতদের বখশিস দিতে চাইলে তার হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দিল শুঁড়ে টাকা দিলে পর্যটককে অভিবাদন করে শুঁড় তুলে হাতিরা তাদের মাহূতের হাতে টাকা জমা করল

হাতির পিঠে গদিতার ওপরে বসার চেয়ার আমরা গদির ওপরে পা রেখেছিলামযাতে হাতির গায়ে পা না লাগে

এতক্ষণ শুধু আনন্দ হচ্ছিল কিন্তু হাতির পিঠ থেকে নেমে, এই বিশাল প্রাণীকে মানুষ কিভাবে দাসত্ব করাচ্ছে ভেবে খারাপ লাগল হাতির পিঠে গদি, তার ওপরে বসার চেয়ার আমরা গদির ওপরে পা রেখেছিলাম, যাতে হাতির গায়ে পা না লাগে কিন্তু দেখছিলাম অন্য হাতিতে লম্বা চওড়া মানুষজন পা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন হাতির চলার দুলকি চালে তাঁদের পাও দুলছিল ভারী ভারী স্নিকার্স পরা পাগুলো বার বার জোরে জোরে হাতির গায়ে লাগছিল বিশাল প্রাণীটা সেটা সহ্য করেই নীরবে কচি বাচ্চা নিয়ে মানুষের দাসত্ব করছিল

আবার ছোট গাড়িতে জঙ্গলের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম মনে প্রশ্ন জাগল, বনকে বিব্রত করে এই আনন্দ পাওয়ার কি সত্যি আমাদের ভীষণ দরকার ছিল? 

 

 *অধ্যাপিকা, প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজ


Comments

  1. খুব ভালো লাগল। মা হাতি ও বাচ্চাদের কথা জেনে আনন্দ পেলাম।

    শেষের প্রশ্নটি যথার্থ ই

    ReplyDelete
  2. Aagei porechhi. Abar porlam. Khub bhalo laglo

    ReplyDelete
  3. Lekhata Khub bhalo hoeche ebong chobi gulo dekhe Khub bhalo laglo. Shesher proshno jothartho.

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগলো পড়ে। আমারও এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা মীনাক্ষী র পিঠে উঠেছিলাম। তার ছানাটাও নানান মজার কান্ড করছিল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

Plant trees more to save Mother Earth