বর্ষারানি

সঙ্গীতা সেন

ছোটবেলা থেকেই বর্ষাকাল আমার ভীষণ প্রিয় স্কুলে যখন ছিলাম বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করতাম "এই তোর প্রিয় ঋতু কি রে?" কেউ বলত গ্রীষ্মকাল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু কত্ত কিছু খেতে পাই কেউ আবার বলত শীতকাল ওই যে নরম গরম লেপের উষ্ণতা আর কমলালেবু পাবে বলে মনে হয় কেউ কেউ তো দুগ্গি মায়ের আসার খুশিতেই বলে বসত, আমার বাবা শরৎকাল প্রিয় পুজোর ছুটি, নতুন জামা, ঠাকুর দেখা, ভালো ভালো জিনিস এর অন্ত নেই যে শরৎকাল জুড়ে

আমি আর মুখ ফুটে বলতে পারতাম না, যে আমার বর্ষাতেই ভরসা। পাছে কেউ বলে বসে, " ইস্! তুই কি রে? প্যাঁচপ্যাচে কাদার স্যাঁতস্যাতে মরসুম তোর ভাল লাগে

শুধু একটিমাত্র প্রাণপাখি ছিল আমার যে কিনা বলত তার বর্ষাকাল প্রিয়। অরুনিতাসাধ করে আবার অরু বলে ডাকি। কি যে মনের মিল আমাদের তা ভাষায় ব্যক্ত করতে গেলে আস্ত এক উপন্যাস হয়ে যাবে

বলে সোঁদা মাটির গন্ধ, তো আমি বলি বৃষ্টির জলে ডালপালার নাচন। সবই যেন কি মধুর। সারমেয়  থেকে পাখির স্নান, মেঘের রঙ থেকে শ্বেতশুভ্র শিলকোনও কিছুই বাদ থাকেনা, আমাদের বর্ষারানি প্রশংসায়। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় শুধু তার বৈচিত্র্য নিয়ে খুঁটিনাটি বলতে বলতে। 

আমার এখনও মনে আছে ছোট্টবেলায় যখন পাড়ার অলিগলিতে খেলাধূলায় মেতে থাকতাম।  কখনও উত্তর, কখনওবা দক্ষিণের কোণ থেকে যেই কালো মেঘ তাড়া করে গোটা নীলটাকে ঢেকে ফেলত আমি আমার সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে সেদিকেই মুখ বাড়িয়ে ছুটতাম কালো মেঘের ঠান্ডা বাতাস একটুখানি যদি পাওয়া যায়। 

প্রাইমারীতে থাকতে আমাদের প্রকাণ্ড স্কুলের চওড়া রাস্তায় বেশ জল জমত। বাসকাকু দুটি  দুটি করে ছানা কে কোলে করে সযত্নে সেই জল পাড় করত। এরকমই এক অঝোর বৃষ্টির দিনে বাসকাকু আমায় বলে গেল তুই দাঁড়া আমি আসছি।ব্যাস আহ্লাদে আটখানা আমি সেই কোমড় জলে ছলাৎ ছলাৎ করে চললাম, এখনও মনে আছে কি বকাটাই না খেয়েছি আমি সেদিন। কিন্তু মন খুশী করা এক অনুভূতি জন্মেছিল। তারপর তো যখন হাইস্কুলে উঠলাম কে পায় আমাদের? ছাতা ব্যাগে নিয়ে ভিজে ভিজে ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। থুড়ি আমাদের স্কুলের মাঠটি কম কিসে?

এখন যদিও বর্ষারানির মতিগতি পাল্টে গিয়েছে, সে ভারী অভিমান করেছে। কখনও ভাসিয়ে দিয়ে যায় আবার কখনও বলে কিছুই দেবনা তোদের, খুব স্বার্থপর রে তোরা। আমিঅরু আর  আমাদের মত আরও কত্ত কেউ খুব কষ্ট পাই 

জানেন তো, সূয্যিমামার প্রখর রক্ত চাউনির পর যখন বর্ষা প্রথম একরাশ ঠান্ডা বইয়ে আমাদের শান্ত করে আমি এক ছুট দিয়ে ছাদে যাই অথবা জানলার পাশে বসে পড়ি।  পাতাগুলো কেমন প্রাণহারা খুশিতে দুলে ওঠে তা দেখার জন্য। জলের ফোঁটার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে নাচতে থাকে অবিরাম, একটুও জিরোনোর নাম নেই তাদের আনমনেই গুনগুনিয়ে উঠি, "মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো" আর কখনও পাখি গুলোকে দেখেছেন? খুশিতে ডগমগ হয়ে স্নান সেরে গা ঝাড়া দিতে! আমি এসব দেখতে  দেখতেই Phone টা হাতে তুলে নিই, অরু কে লিখি " oi, ekhane raining 🌧 re" , আর শুরু হয়ে যায় অনর্গল কথোপকথন আমাদের।  

যখন আমরা ভিনরাজ্যে, দুজনের এক হয়ে যাওয়া কথার স্রোতে ভাসি। আমি বললে যেন চোখ বুজে জলের ঝাপটা নিয়ে নিতে পারে। আর বললে আমি পৌঁছে যাই কালো মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়ের ঢালে। এই নাহলে বন্ধুত্ব। 

বর্ষার দিনরাত সবই ভালো লাগে আমার কিন্তু ওই নীলচে, সাদা, বেগুনী লাইট জ্বালিয়ে "গুরুমদাদা" যেই না আসে, আমি তো ফুস্! শুধু পাশবালিশটাই জানে সেই অসয়হতা।  সবকিছুর মধ্যেই মনে হয় একটা কথা। ঘরে বসে ছাদে গিয়ে আমরা নয় দিব্যই কাটিয়ে দিলাম।  কিন্তু footpath, উড়ালপুল, ভাঙা চালার নীচের মানুষগুলো কি অসহায় ভাবে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। হয়ত মনে মনে বলে, একটু থামাও না ঘুমিয়ে নিই অথবা রান্নাটুকু সেরে নিই। ওদের জন্য মনটা মুষড়ে ওঠে। আবার সৃষ্টিকর্তাকে ডাক দিই। বলি 'ওদের ভালো রেখো গো' কখনও যদি দেখি রাস্তার কচিকাঁচা গুলো দুহাত পেতে বর্ষারানিকে কাছে ডাকছে, ছড়ি ঘুড়িয়ে আপনমনে নেচে বেড়াচ্ছে মনটা একটু আরাম পায়। মনে মনে ভাবি ভালোমন্দ মিলেই তো আমরা আমাদের জগৎ। তবে প্রকৃতির সবটুকু আপন করে একসাথে থাকা যায়না কি?

*ছাত্রী, ২০১৩

 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

Art Works by Arpita Mondal